শিক্ষকদের অবশ্যই জানা প্রয়োজন একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে। আজকের পোস্টে একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক সহায়িকা বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
শ্রেণিকক্ষে একটি শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে ও বজায় রেখে যথাযথভাবে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া পরিচালনা করা একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। শিক্ষককে তাই হতে হবে শিশুর বন্ধু। শিশুর সাথে তিনি এমনভাবে মিশে যাবেন, কথা বলবেন অথবা যোগাযোগ ও মিথষ্ক্রিয়া করবেন যাতে শিশু পরম আস্থার সাথে তার ওপর নির্ভর করতে পারে, যেমনভাবে সে নির্ভর করে তার বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের ওপর। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকা হবে তাই সহায়তাকারীর (ঋধপরষরঃধঃড়ৎ) যিনি শিখনবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে পদে পদে শিশুকে নানা কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে তাকে নানাভাবে শিখতে সহায়তা করবেন। নিচে একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রধান কিছু গুণাবলির উল্লেখ করা হলোÑ
- শিশুর সাথে সবসময় হাসিখুশি থাকা;
- ধৈর্যশীল হওয়া;
- বিভিন্ন কাজে শিশুদের সহায়তা করা;
- শিশুর কথা শোনা ও মতামতের গুরুত্ব দেওয়া;
- শিশুর সাথে শিশুসুলভ আচরণ করা;
- শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা;
- শিশুদের মাতৃ¯েœহে শিক্ষা দেওয়া;
- শিশুর কাছে নিজেকে আদর্শ (জড়ষব গড়ফবষ) হিসেবে তুলে ধরা;
- শিশুদের অভিভাবকদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা।
প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে একজন শিক্ষক শিশুদের পাঠদান থেকে শুরু করে শ্রেণি পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন। কাজের ধরণ অনুসারে শিক্ষকের কাজগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন;
- শ্রেণি ব্যবস্থাপনা
- পাঠ পরিচালনা
- উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
- বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ
- সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি
খ.১ শ্রেণি ব্যবস্থাপনা
প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের শ্রেণি ব্যবস্থাপনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন শিক্ষক। শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় তার যে সকল দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো নিম্নরুপ;
শ্রেণিকক্ষ আকর্ষণীয় করে সাজানো
একটি সাজানো-গোছানো শ্রেণিকক্ষ শিশুদের মননশীলতার বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সাজানোর জন্য শিক্ষক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারেন। যেমন -
- শ্রেণিকক্ষে শিশু উপযোগী বিভিন্ন পোস্টার, চার্ট ইত্যাদি টানিয়ে রাখা। তবে এগুলো শিশুর দৃষ্টি সীমার মধ্যে টানাতে হবে।
- শিশুদের আঁকা ছবি এবং বিভিন্ন হাতের কাজ দিয়ে শ্রেণিকক্ষ সাজানো। তবে ছবিগুলো কিছুদিন পরপর পরিবর্তন করতে হবে। মাটি,পাতা বা কাগজের তৈরি উপকরণগুলো শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে সুন্দর করে লাগিয়ে বা ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে।
- ইচ্ছেমতো খেলার জন্য বিভিন্ন কর্ণারের উপকরণগুলো নির্ধারিত কর্ণারে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা।
- দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় একটু নিচে বø্যাকবোর্ড লাগানো যেন শ্রেণিকক্ষের সবচেয়ে ছোট শিশুটিও তা দেখতে ও ব্যবহার করতে পারে।
বিভিন্ন কাজ অনুযায়ী শিশুদের বসানো
কাজের ধরন অনুযায়ী শিশুদের কখনো বড় দলে আবার কখনো ছোট দলে বসাতে হবে। বড় দলের সময় আকৃতিতে বসাতে হবে যেন শিশুরা একে অপরকে দেখতে পায়। ছোট দলের সময় শিশুরা গুচ্ছ আকারে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে এমন দুরত্বে বসবে যেন প্রতিটি দলের কাছে সহজেই যাওয়া যায়। আবার গল্প বলার সময় শিশুদের গল্পের আসরের মতো (কাছাকাছি জড়ো করে) বসাতে হবে।
শ্রেণিকক্ষের ভিতর ও আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা
শ্রেণিকক্ষ সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এজন্য করণীয় কাজগুলো হলো- নিয়মিত ঝাড়– দেওয়া ও ঝুল পরিষ্কার করা, উপকরণগুলো মুছে ও গুছিয়ে রাখা। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষের বাইরের চারপাশও পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। এ সকল কাজে শিশুদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষক নিজে উপস্থিত থেকে কাজটি তত্ত¡াবধান করবেন।
বাহিরে খেলার জায়গা
শ্রেণিকক্ষের আশেপাশে নিরাপদ ও উন্মুক্ত জায়গায় (যেমন মাঠ, গাছের ছায়া ইত্যাদি) দলীয় খেলার আয়োজন করতে শিক্ষক উদ্যোগী হবেন। শিক্ষক সহায়িকায় বর্ণীত খেলা ছাড়াও স্থানীয় ভাবে প্রচলিত খেলা (যেমন গোল্লাছুট) এক্ষেত্রে আয়োজন করা যেতে পারে। তবে স্থানীয় খেলা নির্বাচন ও খেলার সময় শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখতে হবে।
খ.২ পাঠ পরিচালনা
শিক্ষক সাপ্তাহিক রুটিন ও প্রতিদিনের পাঠ পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নির্ধারিত কাজসমূহ পরিচালনা করবেন। কাজের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষককে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। পাঠ পরিচালনায় শিশুদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে রুটিনে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
খ.৩ উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে স্থানীয়ভাবে কিছু উপকরণ সংগ্রহের প্রয়োজন পরবে। যেমন, পাতা, কাঠি, কাগজ, বোতাম, ছোট ইটের টুকরা বা পাথর ইত্যাদি। পাঠ পরিচালনার রুটিন অনুসরণ করে শিক্ষক ক্লাস শুরুর পূর্বেই প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ সংগ্রহ করে রাখবেন। ইচ্ছেমতো খেলার জন্য চারটি কর্নারে বিভিন্ন ধরনের উপকরণের তালিকা দেওয়া আছে যেখানে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা যায় এমন অনেক উপকরণ রয়েছে। শিক্ষক নিজ উদ্যোগে এবং অন্যদের সহায়তায় এসব উপকরণসমূহ
শ্রেণিকক্ষে শিশু উপযোগী বিভিন্ন পোস্টার, চার্ট ইত্যাদি টানিয়ে রাখা। তবে এগুলো শিশুর দৃষ্টি সীমার সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। শ্রেণিতে বিভিন্ন কাজের সময় শিশুরা যে সব খেলনা তৈরি করবে শিক্ষক সেগুলোকেও কর্নারে দেওয়ার জন্য সংরক্ষণ করবেন। এছাড়া শিক্ষক শিশুদের পিতামাতা ও স্থানীয় অভিভাবকদের সহায়তায় বিভিন্ন খেলনা সংগ্রহ করতে পারেন তবে তা হতে হবে শিশু বান্ধব এবং নিরাপদ।
সংগৃহিত উপকরণগুলো দীর্ঘদিন আকর্ষণীয় ও টেকসই রাখার জন্য যথাযথ সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। উপকরণ সংরক্ষণে শিক্ষক নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারেন-
- প্রতিদিন কাজের শুরুতে যেখানে যে উপকরণ প্রয়োজন, সে অনুযায়ী উপকরণগুলো সাজিয়ে রাখবেন।
- প্রতিদিন কাজ শেষে উপকরণগুলো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখবেন। এক্ষেত্রে শিশুদেরকে সম্পৃক্ত করে দায়িত্ব দেওয়া যায়। তবে কোন কোন দায়িত্ব কে কে পালন করবে, তা দিনের শুরুতে শিশুদের জানিয়ে দিতে হবে।
খ.৪ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। শিক্ষককে এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী শিশু, অভিভাবক, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট অফিসের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।
খ.৫ সামাজিক সচেতনতা তৈরি
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদনের জন্য সামাজিক সচেতনতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান শিক্ষক ও অভিভাবকগণ যদি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন এবং কাজের গুরুত্ব বোঝেন, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে সবসময় সহযোগিতা পাওয়া যাবে। সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে শিক্ষক নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারেন।
- অভিভাবকদের সাথে প্রতি মাসে একটি করে সভা করা। সভায় প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা।
- বিভিন্ন সময়ে শিশুদের বাড়িতে যাওয়া এবং তাদের ভালোমন্দ নিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করা।
- বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে নিজে উদ্যোগী হয়ে অভিভাবকদের সাথে কথা বলা এবং কুশল বিনিময় করা।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকের দৈনন্দিন করনীয়
- পাঠদানের শুরুতে শিক্ষক কেন্দ্রে উপস্থিত শিশুদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন এবং তাদের সুবিধাঅসুবিধার কথা জানতে ও তা দূর করতে সচেষ্ট হবেন। এজন্য কোনো ধাঁধা, ঘটনা, গান বা গল্পের মাধ্যমে আনন্দদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করবেন।
- জাতীয় সংগীত এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে প্রতিদিনের কাজ শুরু করবেন।
- পাঠদানের সুবিধার্থে প্রতিটি বিষয় রুটিন অনুযায়ী শিশুদের করাবেন।
- শিক্ষক প্রতিদিন যে যে বিষয় পড়াবেন তার আগের দিন অবশ্যই ঐ বিষয় অনুযায়ী প্রস্তুতি নেবেন। এতে ক্লাস
- পরিচালনা সহজ ও আনন্দদায়ক হবে।
- বিষয়বস্তু উপস্থাপনের সময় উপকরণের প্রয়োজন হলে (যেমনÑ ফুল, বিচি, কাঠি ইত্যাদি) শিক্ষক সেই
- বিষয়বস্তু উপস্থাপনের পূর্বের দিন শিশুদেরকে কী কী উপকরণ নিয়ে আসতে হবে তা বলে দেবেন।
- শিক্ষক অবশ্যই সেদিকে নজর রাখবেন।
- প্রতিটি বিষয় উপস্থাপনের সময় শিশুদেরকে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করবেন।
- প্রতি সপ্তাহের শেষ দিনে যতটুকু সম্ভব নির্ধারিত বিষয়গুলো নিয়ে পুনরালোচনা করবেন।
- শ্রেণিকক্ষের বাইরে জায়গা থাকলে সেখানে খেলা ও ব্যায়াম করাবেন। যদি বাইরে জায়গা না থাকে তাহলে কেন্দ্রের ভেতরে করাবেন।
- নিজ নিজ বই, খাতা, খেলনা ইত্যাদি গুছিয়ে রাখার জন্য শিশুদের উৎসাহিত করবেন। সকল ধরনের চার্ট এবং উপকরণ ক্লাসে ব্যবহারের পর শিক্ষক সেগুলো ভালোভাবে গুছিয়ে রেখে দেবেন।
- শিক্ষক শিশুদের বিভিন্ন পারিবারিক ঘটনা বা অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ করে দিবেন। বিশেষ করে গল্প বলার সময় গল্পের চরিত্র বা ঘটনা শিশুদের অভিজ্ঞতার সাথে মেলাতে সচেষ্ট হবেন।
- মিলেমিশে থাকা, পারস্পারিক স¤প্রীতি বজায় রাখার বিষয়ে শিক্ষক শিশুদের নিকট বিভিন্ন গল্প, উদাহরণ উপস্থাপন করবেন।
- ছোট-খাটো ঝগড়া বিবাদ মন কষাকষি নিরসনে শিক্ষক সচেতন থাকবেন।
- বিভিন্ন প্রকার ভালোলাগা, খারাপলাগা ও সুখ-দুঃখের অনুভূতি শেয়ার করতে শিক্ষক শিশুদের উদ্বুদ্ধ করবেন।
- বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, সকলে মিশে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষক শিশুদেরকে নিয়মিত বলবেন এবং
- ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগাতে সচেষ্ট করবেন।
- ক্সমিথ্যা বলা এবং অন্যের জিনিস না বলে নেয়া অন্যায়, সত্য কথা বলা ইত্যাদি বিষয় ছোট ছোট মজার গল্প বা ঘটনার আলোকে শিক্ষক শিশুদের নিকট উপস্থাপন করবেন।
- পাঠদান শেষে শিশুদেরকে পরবর্তী দিনে আবারও আসার জন্য আকর্ষণীয় কিছু বলে ধন্যবাদ/শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্লাস শেষ করবেন।